এবার একটু বেড়িয়ে আসি চলুন। অনেক দিন হল সিনেমা দেখতে বা খেতে ছাড়া এখানে এসে বেরুইনা। সবই তো বহুবার দেখা। তাই কিছু ছবি বেশ পুরোনো পাবেন কিন্তু।
প্রথমেই বলি সায়েন্টিফিক সেন্টারের কথা। কুয়েতে আমার সব থেকে প্রিয় জায়গা। মূলতঃ এটা সমুদ্রের নিচের একোয়ারিয়াম। আগে ঢোকার মুখে অনেকদিন টিরেক্সের কঙ্কাল বিরাজ করত। তারপর অন্য দেশের পালি আসায় তাকে বিদায় দিতে হল।
ঢোকার পর কুয়েতের নাব্যজীবনের অনেক যন্ত্রপাতি এবং বেশ কিছু প্রাচীন তার ও তালবাদ্যের সমাহার দেখতে পাওয়া যায়। এর পর কার্পেট মোড়া পথে যেমন যেমন নামবেন বিশাল বিশাল কচ্ছপের মৃতদেহ পেরিয়ে এক দুর্গন্ধময় অন্ধকার জগতে প্রবেশ করবেন।দেখবেন বিড়াল ও ইঁদুর প্রজাতির দুষ্টুমিষ্টি চঞ্চল ছোট্ট ছোট্ট বিরল প্রাণী। সবার নাম জানিনা।ভয় পাওয়ার কিছু নেই, ওদের আর আপনার মধ্যে মোটা কাচের দেওয়াল।
তারপর আবার হঠাৎ আকাশ দেখতে পাবেন, যেখানে দুপাশে এবং মাথার ওপরেও পুরু কাচের আস্তরণ। কাচের ওপারে আচমকা বিশাল মোটা গোলাকার গদি দেখে ভাববেননা আহা এপারে থাকলে একটু বসতে পারতেন। ওটি একটি শান্তশিষ্ট নিরীহ অজগর। এছাড়াও আছে আরও গোটা দশেক রকমারি দেশীবিদেশী নানাজাতের সরীসৃপ ও সর্পকুল।
ক্রমে আরও এগিয়ে যান। দেখবেন কাচের ওপারে হাঁসের মত কয়েকটা পাখি সোজা হয়ে ঘুরছে হাঁটছে। চেনা চেনা লাগবে। তবে মরুভূমির গরমে তাদের অস্তিত্ব এতই অপ্রত্যাশিত যে দুবার চোখ কচলে নিতে হবে। ওরা পেঙ্গুইন। ওদের রাখার জন্য কি প্রচণ্ড খরচ করে মরুর মেরুকরণ করতে হয়েছে, তা সহজেই অনুমেয়। পেঙ্গুইন দেখেটেখে পাশের খোপে একটু ভোঁদড় দেখে পরের কম্পার্টমেন্টে ঢুকে যান।
এবার ওপরে তাকালে দেখবেন জল। বলা বাহুল্য দুপাশেও জল। অর্থাৎ সমুদ্র। মানে দ্রষ্টব্যরা মুক্ত, দর্শকরা কাচের খাঁচায় বন্দী। অসাধারণ রক্ষণাবেক্ষণ। কোথায় লাগে কলকাতার মাছ ঘর বা ভাইজ্যাগের মৎসদর্শিণী।
অক্সিজেন মাস্কের ঝামেলা ছাড়া, স্নরকেলিং বা স্কুবা ডাইভিংয়ে না ভিজেও জলের জীবদের দেখুন তাদের আপন রাজ্যে স্বাধীন সুগম জীবনের স্বাভাবিক চলাচলে।
ছোট মাছদের ছোট ছোট খোপ খোপ ঘর পেরিয়ে মূল বিশাল জলরাজ্যে পৌঁছে দেখতে পাবেন প্রায় দেড়শ রকম অতিকায় বীর মীন। বসার জন্য কাঠের গ্যালারি আছে। নেই কোন সময়ের বাধা নিষেধ। বসে বসে মুগ্ধ হয়ে দেখা যাবে ব্যারাকুডা, সোর্ড ফিশ, স্করপিয়ান ফিশ ইত্যাদি ছাড়াও নানা রকম অতিকায় হাঙর।
প্রসঙ্গতঃ আমার বাবা এখানে এসে হাঙর দেখে যথারীতি আমার হাত ধরে হনহন করে বেরিয়ে এক্কেবারে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালেন। হাঙরদের সমবেত গুঁতোয় কাচ ভেঙে গেলে শুধু আমাকেই নাকি আস্ত গিলে খাবে। কারণ আমি তো সাঁতার জানিনা যে হাঙরের তাড়া খেয়ে সাঁতরে পালাব।
সায়েন্টিফিক সেন্টারের বাইরে বেশ পাড় বাঁধানো সমুদ্র। পারস্য উপসাগর। আরামে বসে কোস্টা কফির টুকটাক খেতে খেতে প্রকৃতি দর্শন খুব মনোরম।
নানা রকম একগাদা মস্ত মস্ত এমিউজমেন্ট পার্ক আর ওয়াটার পার্ক ছাড়াও আছে লিবারেশন টাওয়ার, তার মাথায় ঘূর্ণমান একটা রেস্টুরেন্ট। উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় এই টাওয়ারটা নির্মীয়মান ছিল। যুদ্ধের সময় কাজ স্থগিত রেখে পরে শেষ করে নাম রাখা হয় লিবারেশন টাওয়ার।
কুয়েতের সিম্বল কুয়েত টাওয়ার অপূর্ব দেখতে। পাশাপাশি দুটো টাওয়ার একসময় দেশে জল সাপ্লাই করত। গোলাকৃতি ট্যাঙ্ক দুটো ভারি দৃষ্টিনন্দন। সাদ্দাম হোসেনের দাপটে এই টাওয়ার দুটো ভেঙে যায়। পরে আবার সারিয়ে আরও একটা গোল বানিয়ে সেটাকে রিভলভিং ওয়াচ টাওয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ওপর থেকে পুরো কুয়েত আর সমুদ্র দেখতে খুব ভালো লাগে। আগে পরে বহুবার গেলেও আমার পিতৃদেব এসে এই ওয়াচ টাওয়ারে চড়ে যেই জানলেন আমরা ছ শ ফিটেরও বেশি উঁচুতে ঘুরছি, অমনি আমাদের হ্যাট হ্যাট করে তাড়া দিয়ে নামিয়ে আনলেন ; আমাদের নিয়ে ওটা যদি ভেঙে পড়ে।
লেখক:
গার্গী চক্রবর্তী (ভারত)
চলবে……